অভ্যন্তরগামী সংকীর্ন পথ (কিছু অংশ)
মূল: মাৎসুও বাশো (১৬৪৪-১৬৯৪)
ইংরেজি অনুবাদ: স্যাম হ্যামিল
বাংলা ভাবানুবাদ: ম হাসান
১.
চন্দ্র এবং সূর্য চিরায়ত দুই পরিব্রাজক। এমনকি বছরও এগিয়ে চলে। জীবন যেনো ভেসে চলা একটি নৌকো, অথবা একটি পরিভ্রমণে ক্লান্ত ঘোড়া, প্রতিটি দিন এক ভ্রমণ আর সেই ভ্রমনই এক গৃহ। সেই প্রাচীন কাল থেকে কতো না পথিক হারিয়ে গেছে পথে পথে। তবু হাওয়ায় উড়িয়ে নেওয়া মেঘেরা সর্বদা আমায় টেনে নিতে চায় জীবনব্যাপি এক ভ্রমনের স্বপ্নে। এইতো গত হেমন্তে উপকূলে এক বছরব্যাপি বিচরণ শেষে গৃহে প্রত্যাবর্তনের পর, সুমিদার তীরে আমার কুঁড়েঘরের মাকড়সার ঝুল পরিষ্কার করেছিলাম আসন্ন নতুন বছর উপলক্ষে, কিন্তু বসন্তের কুয়াশা ক্ষেত থেকে ওঠা শুরু হতে না হতেই আমি শিরাকাওয়া বাঁধ পেরিয়ে উত্তরের অভ্যন্তরে যাত্রার জন্যে উন্মুখ হয়ে উঠলাম। ভ্রমনকারী দ’সজিন এর আত্মা যেনো ভর করলো আমায়, আমি মনসংযোগ করতে পারছিলাম না কিছুতেই। আমার সুতি পাজামায় তালি মেরে, বাঁশের টুপিটায় একটা নতুন বাঁধুনি লাগিয়ে, আমি দিবাস্বপ্ন দেখতে লাগলাম। মোক্সা ঘষে ঘষে পা দু’টোকে শক্ত করে, আমি স্বপ্ন দেখলাম এক উজ্জ্বল চাঁদ যেনো উদিত হচ্ছে মাৎসুশিমার উপরে। তাই আমি অন্য আরেক জনের হাতে আমার ঘরের দায়িত্ব দিয়ে চলে গেলাম জনাব স্যাম্পের গ্রীস্মকালীন আবাসে আমার যাত্রার প্রস্তুতি হিসেবে। এবং এই চরণগুলো রেখে গেলাম আমার দরজায়:
এমনকি এই ঘাসের কুঁড়ে
হয়তো রুপান্তরিত হবে –
এক পুতুলের ঘরে
২.
তৃতীয় চন্দ্রের সাতাশতম দিন খুব ভোরে, সূর্যোদয়পূর্ব অস্পষ্টতা, স্বচ্ছ চাঁদ তখনও দৃশ্যমান, ফুজি পর্বত একটা ছায়ার মতো, আমি যাত্রা শুরু করলাম উয়েনো এবং ইয়ানাকার ফুটন্ত চেরীফুলগুলোর নিচ দিয়ে। আবার কবে ওদের দেখতে পাবো? কয়েকজন বন্ধু জড়ো হয়েছিলেন গত রাতে এবং আমার সঙ্গে এসেছিলেন অনেক দূর, নৌকা থেকে বিদায় দেবার জন্যে। সানজুতে নেমে গিয়ে আমার মনে হলো যেনো তিন হাজার মাইল ছুটে চলেছে হৃদয়ের ভেতর, সমস্ত পৃথিবী যেনো এক স্বপ্ন। আমি তা দেখতে পেলাম বিদায়ী অশ্রুর ভেতর দিয়ে:
বসন্ত চলে যায়
এবং পাখিদের আর্তচিৎকার – অশ্রু
মাছেদের চোখে
আমার তুলিতে এই প্রথম শব্দগুলোর সাথে আমি হাঁটা শুরু করলাম। যারা পেছনে থেকে যায় তারা দেখে এক পথিকের পিঠের ছায়া ক্রমশ মিলিয়ে যায়।
৩.
তৃতীয় চন্দ্রের শেষ রাত্রী। নিক্কো পর্বতের পাদদেশে এক সরাইখানা। সরাইখানার তত্ত্বাবধায়কের নাম হোতেকে গোজেমন অর্থাৎ জো বুদ্ধ, যার সততার খ্যাতি তাকে এই নামে পরিচিত করেছে। তিনি আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন এবং বললেন এ আপনাদের আপন ঘরের মতো মনে করুন। এক সদয় বুদ্ধ কতো সাদামাটা চেহারায় তিনি হঠাৎ আবির্ভূত হলেন এক পূণ্যার্থীকে সহায়তার জন্যে। তার সারল্য এক দূর্লভ গুণ, তার নিষ্ঠা নিস্কলুষ। কনফুসিয়াসের অনুসৃত সাধুতায় আমার গৃহকর্তা একেবারে ঋষিতুল্য মানুষ।
***
চতুর্থ চন্দ্রের প্রথম দিবসে, আরোহন করলাম এক পর্বতচূড়ার তীর্থে, একদা যার নাম ছিলো ‘দুই তেপান্তর’, পরবর্তিতে নাম বদলে হয় ‘কুকাই’, যখন তিনি এই মন্দির উৎসর্গ করেছিলেন। হয়তো তিনি দেখতে পেয়েছিলেন হাজার বছর পরের ভবিষ্যত, পবিত্র আকাশের নিচে এই তীর্থস্থান,তার সমবেদনা সীমাহীন ছড়িয়ে পড়ছে আট-দিকে, সমানভাবে ঝরে পড়ছে প্রশান্তি চার শ্রেণীর সকল মানুষের উপর। সেই মহিমা যতো মহৎ, তার সামন্যই প্রকাশে সক্ষম এই শব্দগুলো:
আহ – বাকরুদ্ধ সম্মুখে
মুকুরিত এই সবুজ বসন্ত পত্ররাজী
জ্বলন্ত সূর্যালোকে
***
*দ’সজিন: জনপ্রিয় শিন্টো ‘কামি’ বা ‘আত্মা’ যা পথিককে অশুভ আত্মার হাত থেকে রক্ষা করে বলে পূজিত হয়। অনেক সময় একজোড়া সুখী বিবাহিত দম্পতির মূর্তি হিসেবে স্থাপিত হয়ে থাকে।
* মোক্সা: চীন, জাপান, কোরিয়ায় ইত্যাদি দেশে ব্যবহৃত এক রকম ঐতিহ্যবাহী ভেষজ ঔষধী।
Narrow Road to the Interior and Other Writings. trans. Sam Hamill
“ওকু নো হোসোমিচি” যা “দ্য ন্যারো রোড টু দ্য ডিপ নর্থ” এবং “দ্য ন্যারো রোড টু দ্য ইন্টেরিয়র” নামে ইংরেজিতে অনুদিত হয়েছে, এটি জাপানি কবি মাৎসুও বাশোর একটি প্রধান রচনা, যা এডো যুগের জাপানি সাহিত্যের অন্যতম প্রধান গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত । প্রথম সংস্করণটি মরণোত্তর প্রকাশিত হয় ১৭০২ সালে। এটি গদ্য এবং পদ্যের মিশ্রনে লেখা তীর্থযাত্রার দিনলিপি। ১৭ শতকের শেষের দিকে বাশোর জাপানের মধ্য দিয়ে পায়ে হেঁটে একটি মহাকাব্যিক এবং বিপজ্জনক যাত্রার সময় লেখা হয়েছিল। যদিও কাব্যিক রচনাটি তার নিজস্ব অভীজ্ঞতার মূল বিষয়, তবুও লেখাটি অনেক মানুষকে তার পদাঙ্ক অনুসরণ করতে এবং আত্ম-অনুসন্ধান করতে অনুপ্রাণিত করেছে। (উইকিপিডিয়া থেকে)